Wednesday, October 21, 2009

বাঘ ও হরিণী উপাখ্যান

বয়স হলে বাঘের হরিণপ্রীতি খুব কমে যায়,
বাঘ আর শিকারে কি সেভাবে তাকায়?
যেভাবে দেখতো যৌবনে হরিণীর চকচকে দেহ
হরিণী গাত্রের রেখা বাঘমনে জাগাত বিদ্রোহ!
এখন বয়সকালে বাঘ বসে কেবল ঝিমোয়
চারপাশে কত যে বর্ণ নিয়ে হরিণ সেঁধোয়;
বাঘ আর পারেনা তাকাতে
কমে গেছে জোর, থেমে গেছে থাবার বিক্রম
নখগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে
বাঘ আজ থাকে গাছে গাছে।
হরিণী হয়না বুড়ি, হরিণীর অনন্ত যৌবন
যৌবনে ধরা পড়ে বাঘে, হরিণ ফুঁসতে থাকে রাগে,
হরিণীর প্রবল যৌবন
গর্ব এই কতবার যৌবনে বাঘ এসে সঁপেছে হৃদয়
হরিণীর পিছু পিছু ধেয়ে গেছে বাঘের কনভয়।
দিয়েছে ভীষণ ডাক গর্জনে কেঁপেছে জঙ্গল
সুন্দর নয়না পিছু কত ভৌত বাঘের দঙ্গল
হরিণী চপলা পায়ে দৌড়ে গেছে ক্ষেত্র নক্ষত্র জগৎ
বাঘ ছোটে ম্রিয়মান জায়মান ধুলোর সম্বত।
চারপায়ে উড়ে গেছে হরিণীর দল
এখন কান্না শুধু বাঘের সম্বল।
প্রান্তরের ঘাসে ঘাসে বাঘ খুব দিয়েছে গড়াগড়ি
হরিণী উড়িয়া গেছে ঊর্ধ্বাকাশে একদল পরী!
বাঘেরও চিত্রিত দেহ বাঘেরও রূপ রয়েছে অতিশয়
তবু বাঘ হরিণীর পিছু ধেয়ে হয়েছে নিঃসংশয়
যখন যৌবন ছিল হরিণীরা ফেলেছে তপ্তশ্বাস
বনাঞ্চলে বাঘ আজো মূর্তিমান ত্রাস।
এখন বয়স্কালে বাঘ করে করুণ নেত্রপাত
হরিণেরা দূর থেকে দেখে বাঘের সম্পাত
নাত্রিক রূপ নিয়ে কত বাঘ রয়ে গেছে দূর ছায়াপথে
তাদের ডোরার রেখা মিশে গেছে বৃ জগতে।
এখন বনে বনে বাঘ হল মহাকায় ভয়ের আকার।
প্রান্তরে ছড়ানো ছিল তারা
প্রান্তরের রুদ্র ব জুড়েকত দৌড়-ঝাঁপ, কত ভয়ার্ত চীৎকারে
এখনো বাঘের মনে ঢুকে আছে হরিনীর সুপ্ত যৌবন
বাঘ এক ঘোরতর বন।
আদিগন্ত ছড়ানো সবুজে চকচকে হরিণী রোদ্দুরে
বাঘ সোনালী স্বপ্ন নাকি ছড়ায় বিভ্রম থরে বিথরে।
বাঘের যুগ সরে গিয়ে এসে গেছে হরিণী অধ্যায়
হরিণীর আয়ত চোখে বাঘ আজো দেখে বনভূমি
হরিণীর দীপ্তিপূর্ণ বনে বাঘ দেখে
জঙ্গল আর দখলে তো নেই
বনে বনে জনে জনে বাঘদের আত্মমগ্ন করুণ আলাপ
বনে বনে হরিণীরা দিয়েছে মস্ত ঝাঁপ।
আজ বনে বনে জনে জনে রটে গেছে বাঘের কাহিনী
বাঘের হত্যালীলা বাঘের সন্ত্রাস
কেউ কি জেনেছে বাঘেরা ফেলেছে কত নীরব দীর্ঘশ্বাস
হরিণীর শান্ত চোখ হরিণীর মস্ত হৃদয়
কেউ কি জেনেছে হরিণীর অর্ন্তগত ভয়?
কত হরিণ নেচেছে মন্দিরে, কত বাঘ শুয়ে থেকে ঘাসে
দেখছে আকাশগঙ্গায় হরিণীরা উড়ে যায় শুধু
দেখেছে যৌবনকাল উড়ে যায় ধূ ধূ
দেখেছে অধীর গভীর ঋতু জেগে থাকে জাগর ডাঙ্গায়
তাদেরই কিছু ছাপচিত্র রয়ে গেছে বাঘদের গায়
তাদের আনন্দলীলা অবাক ভ্রমনহেতু বিভ্রম জাগায়
বনে বনে রয়ে গেছে কত কত রহস্যের তীর
হরিণীরা মন্দ্র আজ মন্ত্রবেগে ধেয়ে চলে সামন্ত অধীর!
ঐ মহালোকে দলে দলে বাঘ আজ হ’তেছে জড়ো
তাদের ডোরার চিত্রে প্রান্তরের রূপ থরোথরো
তাদের শিকার সব প্রাণ পেয়ে কম্পমান দাঁড়ায়
এখনো জগতের ভয় ঊর্ধ্বলোকে তাপিত তাড়ায়
এখনো বিস্মৃত জগতের স্মৃতি ভীষণ কাঁদায়।
দ্বিমুখী ুধার তেজে বাঘ আজ দ্বিধান্বিত খুব
বাঘিনী তার মেলে আছে বিপুল যৌবন
হরিণীর ুরধার যৌবনের রূপ বাঘিনীরা কবে যে হারায়
হরিণ ও বাঘিনী মিলে হতে পারে অন্য এক প্রেমের বাথান
মাংস রিরংসার টানে শরীরের প্রাণাধিক টান!
পৃথিবীর পথে-রথে বন ছেড়ে দলে দলে বাঘ
বর্ণ পাল্টে ফেলে প্রহরান্তের একান্ত সদ্ভাব
জঙ্গলের প্রতুল অতুল বৃে তুলে বসন্ত নিদাঘ
নিতান্ত তামাশা তুলে ডেকে আনে গভীর প্রভাব।
বাঘের সামন্তযুগ বহুকাল আগে গেছে চলে
মহাকাল এনেছে সমুখে টেনে হরিণের ঢল
তরল যাত্রার ধ্বনি পরম মাত্রার শাখা তোলে
বয়স্ক রাজার মতো সেও শক্তিহীন নির্বাসন কোল।
আজ জঙ্গলের অজস্র ফটোকপিয়ারে মুদ্রিত হতে থাকে
বাঘের যৌবনচিত্র, বাঘের বিক্রম
যাদুঘরে বাঘ প্রদর্শনীর পড়ে গেছে ধূম
কেননা বাঘে আজ অতিশয় নিপতিত ঘুম
নিপাতনে সিদ্ধ যত বাঘের ব্যাকরণ
পৌরাণিক গল্পদের একমাত্র থীমেটিক ঋণ।
হরিণী পৃথিবী ঘিরে বাঘদের ভয়মত্ত ঝাঁপ
হরিণ গিয়েছে চিরে ভয়ঙ্কর কল্পনার খাঁপ
হরিণ হেনেছে বাঘে করুনার অধীর সম্পাত
বাঘেরা কখন ছিল বনভূমে সৌন্দযের্র পাত?
দেখেছি সেবিকাদলে হরিণীর নম্র নেত্রপাত
বাঘের আকাঙ্খা বোঝে, তবু ঢালে মদির প্রপাত
যখন বাঘেরা উড়ে চলে মেঘের তলদেশে
হরিনী সুধার খোঁজে চুর হয়ে যায় ব্র্রদেশে।
বালির সৈকতে যায়, উঠে পড়ে জাভার পর্বতে
কেননা মৈনাক গিরি হারিকিরি মালয় সাগরে
সূর্যøানে গাত্রখোলা হরিনীরা রোদের চাবুক
সুনির্মল ছদ্মবেশে চিত্রময় হরিণও ভাবুক।
তাদের ডোরার রূপে ভিন্ন দেশে উড়ে আসে বাঘ ও হরিণ
দৌড় ভুলে থাবার একান্ত কাছে কাঁপছে সঙ্গীণ!
কেননা জঙ্গলের কিছু রীতি রয়ে গেছে সুভদ্র সমাজের রূপ
বাঘের মুদ্রার ধ্বনি কানে বাজে আর হরিনীরা সাজে অতিরূপ।
আহার পাল্টে গেছে পৃথিবীর কতরূপ খাদ্যের বাহার
কত যে বিভ্রম ঘটে হরিনী ও বাঘের খামার
অকান্ত আশ্লেষে উঠে চুমু খায় ভয়ার্ত কামুক
প্রভাত যমুনা যদি শুদ্ধ করে করুণার বুক।
হরিনীরা কত রূপে সাজে বাঘ আজ বহুরূপী অলস বিভাসে
হরিনীরা মেলে রাখে কতরূপী লুপ্ত সুপ্ত ভাঁজ
বাঘেরা তন্দ্রার শেষে যখন দরাজ
হরিন সঙ্গোপনে খেয়ে যায় মধু
কেননা বাঘের রূপে চিত্র তরিৎময় প্রান্তর, উত্থানরহিত ধূ ধূ।
এ্যালুমিনিয়মের পেট চিরে বাঘদল নেমেছে বালিতেম
ৎসকন্যার দেশে ঘুরে ঘুরে আসে প্রেম নিতে
একান্ত ুধার কাছে পৃথিবীও কত গদ্যময়
আনকোরা পদ্যের গান হরিনীর জেগেছে নিশ্চয়!
প্রভাতে সন্ত খুব রাত্রি হল বাঘের অধ্যায়
রাত্রির যামে কুঞ্জে কুঞ্জে হরিণ লুকায়
কেবল নধর নিতম্বখানি খুলে রাখে ভুলে
যখন লুকানো মুখ বাঁশপাতা ফুলে
চোখ মুঁদে হরিণী বুঝেছে বুঝি জগৎ অচল
হরিণীর অসতর্কতা আজ বাঘের সম্বল।
ঐ যে দিয়েছে লাফ হরিণী উড়াল
ঐ যে দিয়েছে লাফ বাঘের ভয়াল
কোন চিত্রে ধরা পড়ে কোন ুধা প্রবল ধবল
বনভূমে ঐ যুদ্ধে পাখি-টাখি উধাও সকল।
বিপনীর শান্ত ভীড়ে, ব্যাগ্র ব্যাঘ্র সারি
বাঘ গিয়েছে ছুটে হরিণীর ছায়াময় বাড়ি
বাঘ দেখেছে তুলে হরিণীর চিত্রময় শাড়ি
বাঘেরা উন্মাতাল, হরিণীর প্রাণপন পাড়ি।
বিদেশী এসেন্সের ঘ্রাণে আরো কামাতুরা
বাঘের শৌর্যে ঝরে চৈত্রের নিদারুণ খরা।
সাদা পৃষ্ঠা বাঘের বিষাদহরিণী
চিত্রিত খুব বর্ণময় স্বাদ
বর্ষার বাংলাদেশে হরিণীরা করুণ নিষাদ
কান্নার দেশে বাঘদের নিপাট লুকানো খাঁদ।
হরিণীরা ভয়হীন বসে আছে বাঘের ডেরায়
বাঘ যে চন্দ্রভূক সেই তর্কে বাঘকে শাসায়!
বলে তূর্য অতীতের তীর তূণ হেনে
এনেছ অনেক ভীতি, গল্পের সহজ প্রতীতি!
আজ তুলে রাখো
আহ এই মঞ্চতলে প্রেমরীদি মাখো।
সত্যি হল হরিনীরা বাঘের প্রণয়
বাঘ যে হরিনী ঘ্রাণে কত প্রাণময়
হরিনী প্রজন্মে আজ ভরে গেছে বাঘের জঙ্গল
ঈশ্বর অঙ্কিত পথে জপতপ হরিনীর দল।
বাঘ এক পৌরাণিক প্রভূ
হরিণীরা দিয়েছে উড়াল
প্রভুর পায়ের কাছে পড়ে থেকে কতকাল কেটেছে সময়
হরিণীরা মত্ত বায়ূবেগে এসে পড়ে বাঘের প্রাসাদে
আর বাঘেরা দলে দলে ছেড়ে গেছে স্বর্ণ সিংহাসন
হরিণীর জন্য তারা কেঁদেছে প্রাণপন
বাঘ ও হরিণ মিলে বনে বনে কতটুকু জাগাল উদ্ভাস
মানব মনের কাছে রয়ে গেল কত রহস্যের আভাস
কত বর্ণ রুয়ে গেছে হরিণীর পিছু নেয়া ত্রাস।
হরিণী জেনেছে তার পিছু নেয়া বাঘ নয় অন্য কোন ভয়
বাঘও জেনেছে ঐ সমুখে ছোটে হরিণী নয়, অন্য কোন জয়।

হাওয়ার রাত : জীবনানন্দ দাশ

কামরুল হাসান
হাওয়ার রাত’ কবিতাটি কবি জীবনানন্দ দাশের তৃতীয় ও বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’-এর অন্তর্ভূক্ত। নক্ষত্র খচিত জ্বলজ্বলে এক রাতের অসামান্য নৈসর্গিক পটভূমিতে তিনি নির্মাণ করেন ততোধিক অসামান্য কবিতাটি। রাত যে কেবল তারকাখচিত তা নয়, নয় কেবল প্রবল হাওয়ার রাত, সে রাতের বিশাল ক্যানভাসে বর্তমানের নত্রনিচয় শুধু নয়, হাজার বছর আগে মরে যাওয়া অজস্র নত্ররা জেগে উঠেছিল। এই আশ্চর্য রাতের প্রোপটে কবি উপস্থাপন করেন মৃত সব রূপসীদের মুখ যারা দীর্ঘ বর্শা হাতে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছেন মৃত্যুকে দলিত করার জন্য, প্রেমের ভয়াবহ স্তম্ভ তুলবার জন্য। ঐ অতিলৌকিক দৃশ্য অবলোকনে কবি বিস্মিত-বিমূঢ়,ঐ মহাজাগতিক আহবানে মর্ত্যের কবি প্রবল আন্দোলিত। তার হৃদয় ভরে গিয়েছে বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে, অবশেষে পৃথিবী ছেড়ে এক ষ্ফীত, মাতাল বেলুনের মত তাঁর হৃদয় মহাকাশে, নত্রজগতে উড়ে যায়।
কবিতা যে শিল্পের উত্তুঙ্গ চূড়া স্পর্শ করতে পারে- এ কবিতা তার স্যাক্ষ দেয়, এমন চিত্রকল্প ভরপুর, উপমা-উৎপ্রেক্ষা ঠাঁসা, কাব্যিক আবেদন সম্পন্ন, ভাব ও ভাষার অপরূপ সমন্বয়ের কবিতা কটি আছে বাংলা সাহিত্যে? এ কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের কবি প্রতিভার নিদর্শন। সাধারণ কবিগণ হাজার বছর ধরে সহস্র পঙক্তি লিখে গেলেও এমনি একটি মুক্তো কবিতা লিখতে পারবেন না, ঐ বিদ্যুৎস্পর্শ তাদের অধরাই থেকে যাবে। কবিতাটিকে মনে হয় দৈবপ্রেরিত, কবি নামক নবীর মধ্য দিয়ে নাজিল হওয়া দৈববানী, যার সঙ্গে মিশে আছে কবির অসামান্য চিত্ররূপময় ভাষার সংযোজন।
অসাধারণ সব চিত্রকল্পে ঠাঁসা এ কবিতা
১। মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মত (পঙক্তি ৩)
২। স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মত উড়ছে সে (পঙক্তি ৮)
৩। অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মত ঝলমল করছিল সমস্ত নত্রেরা (পঙক্তি ১২ ও ১৩)
৪। জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মত জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ (পঙক্তি ১৪ ও ১৫)
৫। মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে (পঙক্তি ৩)
সমগ্র বাঙলা সাহিত্যেই দুর্লভ এমনি চিত্রকল্প; তাও জড়ো হয়েছে একটি কবিতার ভেতর- ভাবাই যায় না। প্রতিটি চিত্রকল্পই মৌলিক ও কবি-প্রতিভার স্মারক।
অসামান্য সব চিত্রকল্পই শুধু নয়, কবিতাটির শরীরে মনিমুক্তোর মত অসংখ্য ঊপমা বসানো। কবি ফুলে ওঠা মশারীকে তুলনা করেছেন মৌসুমী সমুদ্রের পেটের সঙ্গে; উড়ে যাওয়া মশারীকে কল্পনা করেছেন উড়ে যাওয়া শাদা বকের সাথে; ঝলমলে নত্রদের তুলনা করেছেন প্রেমিক চিলপুরুষের শিশিরভেজা চোখের সাথে: জ্বলজ্বলে বিশাল আকাশকে দেখে তাঁর মনে হয়েছে চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শাল; পৃথিবী ছিড়ে উড়ে যাওয়া হৃদয়কে মনে হয়েছে স্ফীত মাতাল এক বেলুন; বাতাসতে তুলনা করেছেন প্রান্তে উৎপ্তি অজস্র জেব্রার সাথে।
এ কবিতায় বিজ্ঞানের সত্যের সাথে অঙ্গীভূত হয়ে আছে ইতিহাস চেতনা, আর এর সাথে এসে মিশেছে কবির কল্পনা, অধিবিদ্যা ও দর্শন। ‘যে নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার হাজার বছর আগে মরে গিয়েছে’- এ পঙক্তি বিজ্ঞানের সত্যকে ধারণ করে, কিন্তু এরপরই কবি লিখেন ‘তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে’। এটা কবির কল্পনা, বিজ্ঞানের সত্য ছাড়িয়ে কাব্যিক সত্য, যার ভেতর রয়েছে ইতিহাসের বোধ। এ কবিতায় রয়েছে সম্প্রসারিত ইতিহাস চেতনা। বর্ণনাত্মক এক রীতির ভেতর কবি ঢেলে দেন তাঁর প্রগাঢ় ইতিহাসবোধ। কাব্যগ্রন্থের প্রথম ও সুবিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’এর মত এ কবিতাতেও কবি জীবনানান্দ দাশ অতীতের বিস্মৃত সকল অঞ্চল বেবিলন, এশিরিয়া, মিশরে পরিভ্রমণ করেন। যিনি প্রাচীন সব সভ্যতার- এশিরিয়া, মিশর, বিদিশায়- রূপসীদের মরে যেতে দেখেন তিনি তো ঈশ্বরের দৃষ্টি অর্জন করেন।
এ কবিতা পুরোমাত্রায় নষ্টালজিক, তার মুখ অতীতের দিকে ফেরানো। কবিতার যে রূপান্তরের মতা, যে উলস্ফনের শক্তি তা পুরোমাত্রায় মূর্ত হতে দেখি এ কবিতায়। পার্থিব জগৎ থেকে তা পাঠককে নিয়ে যায় অপার্থিব এক জগতে, লৌকিক কবি স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে অতীতের টানে উড়ে চলে যান নত্রসংসারে, সঙ্গে করে নিয়ে যান তাঁর স্বপ্নাবিষ্ট পাঠককুলকে। এ কবিতা তাই বিস্ময়ের, বারংবার পাঠের।
জীবনানন্দকে বলা হয় ধূসরতার কবি, কুয়াশার কবি। তাঁর এই প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতাতেও রয়েছে ধূষর রঙ, কুয়াশা। প্রিয় মৃত মুখদের মনে হয়েছে ধূসর, আর মৃত রূপসীরা অতিদূরে আকাশের সীমানায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছেন যেন।
এ কবিতায় আছে গতি, কবিতাটি কোথাও থেমে নেই, এগিয়ে চলা, বরং বলা ভাল, উড়ে চলাই এর বৈশিষ্ট্য। ‘মশারিটা বিছানা ছেড়ে নত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে’, ‘শাদা বকের মত নীল সমুদ্রে উড়ছে’, ‘উত্তুঙ্গ বাতাস জানালার ভেতর দিয়ে শাঁই শাঁই করে নেমে এসেছে’, হৃদয় পৃথিবী ছেড়ে উড়ে গেছে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো- এমনি আশ্চর্য গতিময় সকল পঙক্তি এ কবিতার চাকায় জুড়ে আছে। প্রকৃতির বিরল সৌন্দর্য কবিকে যেমন সম্মেহিত করেছে, তেমনি লাইনের পর লাইন জুড়ে প্রবল কাব্যিক সৌন্দর্য পাঠকদেরও আড়ষ্ট-অভিভূত করে রেখেছে। কেবল রৌদ্রের আঘ্রাণ নয়, তিনি সে রৌদ্রকে দেখেছেন বলীয়ান রূপে। এভাবে পরাবাস্তবের বিমূঢ় দরোজা খুলে দিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ।
বিস্ময়ের পর বিস্ময় অপো করে আছে এ কবিতায়। জীবনানন্দের অনেক কবিতার মত এখানেও আছে জঙ্গলের রূপময় ও শক্তিমান প্রাণীদের দুর্দ্দান্ত উপস্থিতি; দেখতে পাই আশ্চর্য রূপময় অথচ হিংস্র প্রাণীদের আনাগোনা, তাদের উপমা চিত্রকল্পে এ কবিতার চিড়িয়াখানাটি বর্ণিল ভরে উঠেছে। আছে ‘চিতার উজ্বল চামড়া’, ‘প্রেমিক চিলপুরুষ’, ‘সাদা বক’, ‘হুঙ্কাররত সিংহ’, ‘প্রান্তরে উৎপ্তি জেব্রা’, ‘মিলনোন্মত্ত বাঘিনী’ ও ‘দুরন্ত শকুন’। লণীয় প্রতিটি বিশেষ্যের সাথে চমৎকার সব বিশেষণ তিনি জুড়ে দিয়েছেন; তাঁর কবিতার যে বৈশিষ্ট- চিত্ররূপময়তা- তা ফুটে উঠেছে।
তিনি যে আধুনিক কবি তার প্রকৃষ্ট প্রমান এ কবিতা। আকাশকে তার মনে হয়েছে ‘প্রবল নীল অত্যাচার’, পৃথিবীকে তুলনা করেছেন কীটের সঙ্গে, কবিতাটি শেষ হয়েছে ‘দুরন্ত শকুন’ দিয়ে। প্রেমকে তুলনা করেছেন ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভের সাথে। প্রবল নীল যেমন তাকে বিস্মিত করেছে তেমনি ছিড়ে ফেলেছে অত্যাচারে। কবি দূর নক্ষত্রের মাস্তুল কল্পনা করেছেন আর নিজের হৃদয়ের উড়ে যাওয়াকে মনে হয়েছে দুরন্ত শকুনের মতো। প্রবল পাখাসঞ্চারী, শক্তিশালী পাখিটি কিন্তু অশুভের প্রতীক। তাঁর আধুনিক চেতনা এই শেষ লাইনে ধৃত। তাকে বলা হয় বিপন্ন বিস্ময়বোধের কবি, এ কবিতায় রয়েছে সেই বিপন্ন বিস্ময়বোধ। কবি লিখেন ’আড়ষ্ট, অভিভূত হয়ে গেছি আমি’; সঙ্গে তার অগুণিত পাঠকও। তিনি বিপন্নতার কবি হলেও জীবনের প্রতি তাঁর আশাবাদও প্রবল। তিনি এ কবিতায় নিুলিখিত পজিটিভ শব্দাবলী বা শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন:‘চমৎকার’‘ঝলমল’‘জ্বলজ্বল’‘দিগন্ত-প্লাবিত রৌদ্র’‘ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধ’যা জীবনের ধনাত্বক চিত্র তুলে ধরে। আধুনিক বলেই তিনি এই সৌন্দর্য ও স্থিতির মাঝে ধ্বংসের অবয়বও দেখ ফেলেন; ভোলেন না জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়। মিলনোন্মত্ত বাঘিণীর গর্জনের বা সিংহের হুঙ্কারের ভেতর জীবনের উচ্ছসিত প্রকাশই চোখে পড়ে। সাই সাই ধেয়ে চলা বাতাস বা আকাশের নীল সমুদ্রে ভেসে যাওয়া শাদা বক- তারাও তো জীবনের গতিময়তার মূর্ত ছবি, প্রতীক।
কবিতাটি পড়ে প্রতীয়মান হয়, এটি স্বতঃস্ফূর্ত লেখা বা অটোমেটিক রাইটিং। এর সাথে পরে এসে মিশেছে জীবনানন্দীয় ক্রাফটসম্যানশীপ বা নির্মানকুশলতা। কবির হৃদয়ের এক বিপুল দরোজা খুলে গিয়েছিল সেই হাওয়ার রাতে আর তিনি দৈবতাড়িত হয়ে লিখে ফেলেছেন এই কবিতা। কেবল ঘাসের গন্ধ নয়, রৌদ্রের ঘ্রাণও রয়েছে এ কবিতায়। সেই অনুপম রাতটির বর্ণনায় তিনি লিখেন:
১। গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল
২। কাল এমন চমৎকার রাত ছিল
৩। অসংখ্য নক্ষত্রের রাত
৪। কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিল
বস্তুতঃ ঐ হাওয়াময়, চমৎকার, আশ্চর্য রাত তাকে অভিভূত করেছিল, পুরোপুরি বুঁদ করে রেখেছিল তার রূপের মদে, আর জয় করেছিল কবির হৃদয়; যে হৃদয় আর পৃথিবী নামক গ্রহে থাকেনি, মহাশূন্যের অবারিত ডানার ভেতর নত্রমঞ্জরীর ভেতর উড়ে গেছে। কী দুর্দ্দান্তভাবে তার কবিতায় এসে ঠাঁই নেয় বেবিলনের রাণী, এশিরিয়া, মিশর, বিদিশার রূপসীরা। তিনি যখন বলেন ‘জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের উপর চিতার উজ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ’ তখন মনে হয় এ কবি ঈশ্বরিক চোখ পেয়ে গেছেন, যিনি মহাশূন্য থেকে দেখছেন পৃথিবী গ্রহটিকে. যিনি কাল ও মহাকালকে একসঙ্গে দেখতে পাচ্ছেন। সত্যি, যিনি হাজার বছর আগের মৃত নক্ষত্র ও আকাশকে বর্তমানের এই রাতের ভেতর উপস্থাপন করেন তিনি তো দৈবদৃষ্টিপ্রাপ্ত! মৃত নত্রের তিল ঠাঁই নাই ভীড়ের ভিতর ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখ দেখতে পাওয়াই এ কবিতাকে নিয়ে গেছে অন্য ডাইমেনশনে।
শুধু রাত নয়, হাওয়া কখনো প্রান্তরের মত ‘বিস্তীর্ণ’, কখনো সমুদ্রের মত ‘উত্তুঙ্গ’, আবার কখনো বা আকাশের মত ‘নীল’। গতিময় হাওয়া যে উত্তুঙ্গ হবে সন্দেহ নেই কোন, তার বিপুল ডানা যে বিস্তীর্ণ, তাও সন্দেহাতীত, কিন্তু নীল? জীবনানন্দ দাশের বেশিরভাগ কবিতাই ছন্দে লেখা। তবে এ কবিতাটি গদ্যভাষ্যে নির্মিত। এখানে ব্যবহৃত হয়েছে দীর্ঘ দীর্ঘ সব পঙক্তি; কোন কোন পংক্তি এতটাই দীঘল যে এক লাইন ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়েছে দ্বিতীয় লাইনে। এই দীর্ঘ দীর্ঘ পঙক্তি যেন চরাচরে বিস্তীর্ণ চঞ্চল বায়ুস্রোতকে ধরবার চেষ্টা করেছে, যেখানে কবির স্মৃতির ভেতর দিয়ে রাত্রি জাজ্বল্যমান। গদ্যে লেখার কারণেই তিনি পূর্ণ স্বাধীনতা নিতে পেরেছেন তার বিমূঢ়-বিস্ময়কে ধারণ করার; বর্ণনাতীত এক রাত্রিকে নিপুন বর্ণনায় করে তুলতে পেরেছেন ভাষার এক নিজস্ব সম্পদে।
নক্ষত্র, রাত্রি, আকাশ, বাতাস, সমুদ্র- প্রকৃতির সকল অনুষঙ্গই এখানে আছে; আছে রহস্যময় জঙ্গলের বিচিত্র সব প্রাণী; কিন্তু এরা সকলেই উপল্য মাত্র। এ কবিতার মূল বানী জীবনের গভীর জয়কে প্রকাশ করা, এর সুর একই সঙ্গে নস্টালজিক ও বিস্ময়জাগানিয়া। কিনতু ভয়াবহ সৌন্দর্যেও নীল উৎপীড়নই এই অভিভূত কবিকে পিষ্ট করেছে, দার হৃদপিণ্ড পৃথিবী ছেড়ে উড়ে গেছে নীল সমুদ্রে, নত্র সংসারে। এ এমন এক কবিতা প্রাসাদ যার বহিরাঙ্গের সৌন্দর্য দেখেই বিস্ময়ে বাকহীন হতে হয়, আর অন্দরে প্রবেশ করলে বিস্ময়ের পর বিস্ময় অপেক্ষা করে, জড়ো হতে থাকে নতুনতর সব চমক আর অনুভবের উদ্বোধনের দরোজা খুলে যায়।
সমগ্র বাঙলা কবিতার প্রোপটেই এটি একটি শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এ কবিতার পাঠ নিতে গেলে তাই বারংবার বিস্মিত হতে হয়।

Tuesday, October 20, 2009

ইগোসেন্ট্রিক
আজ ফর্সা রঙ নিয়ে কালোদের দেশে দেশে ঘুরি
কালোরা ম্রিয়মাণ ভারি, শুধু চায় জড়াতে-মেলাতে
ঈর্ষা নিয়ে তাকায়, আর চোখে-মুখে রাখে মুগ্ধপ্রীতি।
ওদের মাড়িয়ে যাই, মুড়িয়ে দিই উপো-চাদরে।

আজ অর্থ নিয়ে শত দরিদ্রের রাজ্যে এসে যাই,
আহারে ওদের অনর্থ লেগে আছে সংসারে, মনে
ওরা এ জঙ্গলের রীতি-নীতি কিছু বোঝে নাই
অর্থের ড্রাগনলেজ, ডাইনোসরগলা দেখে নাই।

মেধাকে বেলুন ফুলিয়ে হাবাদের সভাতে এসেছি
আমার ফলিত জ্ঞান নির্বোধের ক্ষেতে ঢালে ধান,

ফলত: ওদের বালকেরা ইশকুল কবেই ছেড়েছে
এখন ফাঁকা মাঠে এত বাঁশি, এত গোলের উৎসব...

কাকতাড়ুয়া
তাড়াতে পারি না কোন কাক, তবু ওরা ভয় পায় কেন?
মানুষমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, মানবের প্রাণভিক্ষা চেয়ে।
ঐ যন্ত্রের মানুষের মত, বহুকাল নিস্ফল পড়ে থেকে
কলকব্জা নড়ে গেছে, রাশি রাশি জং ধরে গেছে।

আমাকে কি ডেকে নেবে মিছিলে তোমার
হে সাহসী বালিকা, ভীতু সিংহের পাশে ডেকে নেবে?

আমাকে মানুষ ভেবে কোন পাখি কাছে আসে না তো!

প্রীতিটুকু নেব, প্রতিভা নেব না
জানি প্রতিভা জ্বালাবে খুব দিনে-রাতে, দিনে ও রাতে
অগ্নিদেব হতে তার ক’মুহূর্তই লাগে, অগ্নিমূর্তি হতে
এর চেয়ে ভাল টান হয়ে শুয়ে থাকা পর্বতের পিঠে
এর চেয়ে ভাল ডুবসাঁতার অতলান্ত-প্রশান্ত অতলে।

রাধাচূড়া চূড়াটি রেখেছে বেঁধে আকাশের পর্দা টাঙাতে।

স্মৃতির টলমলে জ্বরে থিরথির কাঁপি, আর সান্ধ্যচীৎকারে বলি,
অনাগত রাত্তিরে যে বিভীষিকা কাছে এসে প্রীতি দিতে চায়,

তাকে যদিবা নেব, তাঁর প্রতিভা নেব না।

নামবিভ্রাট
আমরা সকলে কী সাদামাটা নাম নিয়ে ঘুরি।
আর ওরা ঘুরিয়ে নেয়, সাধ্যমত উল্টায় বাটি
গাড়িকে ঘোড়ার আগে জুড়ে দিতে উৎসাহে ছোটে
আমরা সংখ্যাতীত ব্রাত্যজন পাশ থেকে দেখি,
দেখি উদ্ভট নামের যত তারকা-কবি রথ উল্টে
খাবি খায় পথে, রথ ভেঙে পড়ে আছে গ্রহদের ঘরে।

কেবল কয়েকটি সাদামাটা, অশোধিত নাম
মহাকাশে নত্রের উজ্জ্বল দীপ্তি ধরে রাখে।


নীরব যাত্রী
সে পথে তুমি তো নীরব যাত্রী, সঙ্গীহীন একা
এত উজ্জ্বলতা, এত পানীয়, এত হুরপরী মুখ
কেউ যাবে না সাথে, পৃথিবীর পানশালাগুলো
একইরকম ভেঙে যাবে পরীদের ডানার উল্লাসে,
পানীয়ের মুক্তোবিন্দু ভরে দেবে কাচের স্বচ্ছতা।
এই যে অমিত ভক্তদল টেনে রাখে রূপশালী বাহু
এই যে প্রিয়মুখ মুখভরে এঁকে দেয় সহস্র চুম্বন,
পৃথিবীর ভেড়ারা জড়িয়েছে কত তপ্ত ওমের আদরে
কার্পাশেরা জড়িয়ে রাখে শীততীব্র রাতের গভীরে।
ঐ যে প্রজাগণ তোয়াজের অতি নম্রশীর
এই যে পরীগণ ডানামেলা ভীষণ অধীর

ওরা তো অপারঙ্গম তোমাকে ফেরাতে
ওরা কেউ রাজী নয় সে পথে যেতে...